আশা বা এক্সপেকটেশন
পরিবারের কেউ আমেরিকায় আসলে হুলুস্থুল পরে যায়।
হুলুস্থুল পরার যথেষ্ট কারন আছে। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে যাত্রা। বলা যায়, বাংলাদেশের পুরো উল্টা দিকে। বাংলাদেশের সাথে অনেক কিছুই উল্টা পাল্টা। উল্টা পাল্টা পরিবেশে একা একা জীবন যাপন করা একটা হুলুস্থলের বেপার বৈকি। অনেকে বলে নদী থেকে সাগরে আসার উপক্রম, কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, জীবনটাই একটা অনন্ত সাগর, সেটা আমেরিকায় হোক অথবা বাংলাদেশে। সাগর বলে আমেরিকাকে বড় করে, বাংলাদেশ কে কেন ছোটো করা হয়, কে জানে। এটা হতে পারে, যে আসছে আমেরিকায়, সে বড় জায়গায় যাচ্ছে, ভালো জায়গায় আসছে ইত্যাদি বুঝানোর জন্য হয়ত বলে। এখানে আসলেই অনেক ধারণা পাল্টে যায়। তাই বলে আমি বলছি না, আমেরিকা খুব খারাপ জায়গা। আপত্তি শুধু বাংলাদেশকে ছোটো না করে,বাংলাদেশকে প্রাপ্য মর্যাদাটা দেওয়া। হুলুস্থুলে কেন জানি ভুলে যায়, বাংলাদেশটা আমাদের মাতৃভূমি। দেশকে ছোটো করলে কি নিজে ছোটো হয়ে যাই না?
হুলুস্থলে করে এই দেশে এসে দৃশ্য পুরো পুরি পাল্টে যায়। যেই উল্লাসে আমেরিকায় আশা হয়, কাজ করতে করতে সেটা একটা অন্য কিছুতে পরিনত হয়, এই অন্য কিছুটা এক জনের জন্য এক এক রকম। আমি এখানে বিদেশে আশা নিয়ে নেতি বাচক লেখা লেখতে বসি নি। যারা এদেশে এসেছেন, কষ্ট করছেন তাদের অনুভুতিগুলো তাদের থাক। এদেশে আসার পরে নিজের এক্সপেকটেশন যাইহোক, দেশের সবার আশা বা এক্সপেকটেশনটা যে কোথায় যায় আর তার বিপত্তি নিয়ে লেখতে বসেছি।
বিপত্তির গভীরে যাওয়ার আগে, তাদের কথা একটু বলে নেই, যারা শুধুই নিজের আশা বা এক্সপেকটেশনটা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কিছু ভাবে না। তাদের সংখ্যা কম। কেননা বিদেশে যারা আসে তারা সবাই চায়, দেশের সবাইকে সাহায্য করতে। কিন্তু যারা সেটা করে না, তাদের সাথে চললে মনে হয় তারা, ধরাকে সরা জ্ঞান করে। পুরো আমেরিকান হয়ে যায়, কোথায় কোথায় বিভি ন্ন স্লাং ব্যবহার করে। যাচ্ছে তাই অবস্থা। তারা হইতো ভালই আসে। ইয়ো ইয়ো জীবন। খারাপ হবার কথা না। ইয়োর ইয়োর বলয়ে অন্য কিছু চান্স পাবার কথাও না। কেউ তাদের থেকে কোন কিছু আশাও করেও না, তারা কারো থেকে কোন কিছু আশা করে না । মামলা খতম।
এবার আসি তাদের আশা বা এক্সপেকটেশন নিয়ে, যারা নিজের আর দেশের আশা ভরসা নিয়ে দোদুল্যমান। দেশের মানুষের আকাশ চুম্বি এক্সপেকটেশন। সেই এক্সপেকটেশনের কাছে নিজের এক্সপেকটেশনটা মিলেয়ে যায় । বিদেশ নিয়ে দেশের মানুষ কি না চিন্তা করে। মনে করে, ওবামা বুশ বসিয়ে বসিয়ে টাকা দেই। দেশের মানুষের এক্সপেকটেশনই হোক অথবা অন্য কোনো কোনো প্রেসারে, কাজের জীবন শুরু হয়, ওভার টাইম, ডাবল ওভার টাইম করে। করে ভালো কথা, যৌবন যার যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার। যদিও অনেকের যৌবন থাকে না। তবুও যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আঁশ। সবাই প্রচন্ড পরিশ্রম করে। ডলার কামায়, টাকা জমায়। এ গুলো সবই ঠিকই আছে, কিন্তু ওই যে বললাম দেশের আকাশ চুম্বি এক্সপেকটেশন, ওটাই জীবন দুর্বিসহ করে তুলে।
এই আকাশ চুম্বি এক্সপেকটেশন এর দায়ী কিন্তু আমরাই, যারা বিদেশে থাকি। কেউ এখানে কিভাবে কাজ করি, কিভাবে বেঁচে থাকি, সেটার আসল দৃশ্য দেশের কাউকে বলি না, সবায় মনে করে, দেশে বললে হইতো কষ্ট পাবে, তাদের খারাপ লাগবে। এভাবে ভালো আছি, কোনো সমস্যা নেই বলে অমানবিক কষ্ট চেপে যেতে যেতে, দেশের মানুষ মনে করে, ও তো ভালই আছে, কোনো সমস্যা নেই। কাজ করছে ডলার পাঠাচ্ছে। মন্দ কি !
সবচেয়ে বেশি বিপত্তি হয় বিয়ে করতে গেলে। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে। কেননা আমেরিকার ছেলের বাজার দর অনেক ভালো। কাজ যাই করুক, ছেলে আমেরিকায় থাকে তা হলেই হলো। পরিবারের নাক আকাশ সমান উঁচু হয়ে যায়। কয়েকটা ঘটনা বলি।
এক ছেলে আমেরিকায় থাকে বেশ কিছু দিন। খাবার বিক্রি করে ফুড ভেন্দিং স্টোরে । সে এখানে আসার পরে থেকেই, এই কাজে আছে, সপ্তায় ছয় দিন কাজ করে, বার ঘন্টা করে। কাজে যাওয়া আর আসা। কাজের যাওয়ার সময় একবার দেশে ফোন দেয়, আসার সময় একবার। কাজে যাওয়ার সময়ের কথোপকথন, "তোমরা আছ কেমন, আমি আছি ভালই। কাজে যাই". কাজ থেকে ফিরার সময়ের কথোপকথন: "তোমরা আছ কেমন, আমি আছি ভালই। কাজ থেকে বাসায় যাই". এর মধ্যেই তার জীবন। কয়েক বছরের পর, দেশে যাবে বিয়ে করতে। মেয়ে এক আমলার মেয়ে। বেশ কিছু কেনা কাটা করে দেশে গেল। ধুম ধাম করে বিয়ে করলো। কেউ প্রশ্ন করলে, ছেলে কি করে: ছেলে আমেরিকায় থাকে। করে অনেক কিছু। অনেক কিছু করা ছেলে আমলার মেয়ে বিয়ে করে, খাবি খাওয়ার মনে অবস্থা হয়। আগে ছিল পরিবারের এক্সপেকটেশন, এখন বাড়ছে আমলার, আমলার স্ত্রীর আর আমলার মেয়ের। ছেলের পরিবারের নাক অন্য সবার কাছে অনেক উঁচু থাকলেও, ছেলের শশুর বাড়ির কাছে ভোঁতা হয়ে থাকে, থাকে তারা কাঁচুমাচু হয়ে। ছেলেকেও কাঁচুমাচু হয়ে থাকতে বলে। হাজার হলেও আমলার মেয়ে। আর আমলার মেয়ে এই সুযোগে, যাসচ্ছেতাই ব্যবহার করে। অনেক কিছু দিয়েও মান রাখা দায়। নাক উঁচু রাখতে গিয়ে, একি বেহাল অবস্থা! শেষে কি অবস্থা হয়েছিল কে জানে, পরিবারের স্ট্যাটাস না মিলিয়ে বিয়ে দিলে এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে।
আর একটা ঘটনা অনেকটা আগেরই মত। তবে এক্ষেত্রে পার্থক্য থাকে বয়সের। পাত্রের বয়স পৈত্রিশ কি চল্লিশ, মেয়ের বয়স ষোল কি সতের। বিশাস করছেন না। হা, এমনি হয়, ছেলের কাজ করতে করতে বয়স চলে গেছে, কি আর করা! তার উপর ছেলে থাকে আমেরিকায়। মেয়ে ভালই থাকবে। কেমন করে যেন, যেসব ছেলেরা দেশে গিয়ে বিয়ে করে, মোটামুটি সবাই, কম বয়সের মেয়ে খুঁজে। দেশের যে অবস্থা, হয়তো বেশি বয়সের মেয়েদের উপর ভরসা পাই না কেউ। বয়সের পার্থক্য কেউ আর ভেবে দেখে না। চপল মতি এক মেয়েকে বিয়ে করে ধুমধাম করে (আমেরিকান সব পাত্রর বিয়ে ধুমধাম করেই হয়, টাকা পয়সা ধার করে হলেও, (সিস্টেম আছে এখানে) বিয়ে ধুমধাম হবেই). তারপর কঁচি মেয়ের মতের সাথে ছেলের খাপ খায় না। খাপ খায়ই বা কি করে, যার বয়স পয়ত্রিশ বা চল্লিশ, তার জীবনের সব রং দেখা শেষ, আর যার এখন ১৬/১৭ বয়স, তার পৃথিবী সবে রঙিন হতে শুরু করছে। তারউপর পাত্রী অবশ্যই কোটি পতির মেয়ে অথবা শিল্প পতির মেয়ে, তাকে কিছু বলা ভীষন বারন। কিন্তু তার সব কথা শুনতে হবে অক্ষরে অক্ষর। বুঝো ঠেলা ! আবার।কখন কোথায় যাচ্ছে, কি করচ্ছে, কাকে ফোন দিচ্ছে, কাদের সাথে চলচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদির খবরদারি মেয়ে ঠিকই করে । সারাদিন ছেলেকে ধমকের উপর রাখে, ছেলে কিছু বলারি সাহস পায় না। এগুলো হয় শুধু দেশে থাকতে, এদেশে আসার পরে তো বাংলাদেশি পাড়ায় তো থাকেই না। কেননা আমেরিকায় এসে 'বাংলাদেশি দেখতে
মন চায় না', 'এরা বড় নোংরা', ' এরা বড় আড্ডা বাজ' এই সব বলে নাক শিটকায়। কে জানে বেচারার কি অবস্থা হয়, তার অবস্থা জানা যায় না, কেননা এখন তারা থাকে বিদেশী পাড়ায় ।
এই আর একটা ব্যাপার যে, এ দেশে এসে, বাংলাদেশীদের দেখলে, নাক শিটকানো অথবা তাচ্ছিল্য করে । কেন রে বাবা, আপনি তো বাংলাদেশেই জন্মিয়েছেন, বাংলাদেশীদের সাথেই বড় হয়ে উঠা, এখানে আসলে ওবামার খালতো ভায়ের নাতি হয়ে যান নাকি। অথবা সপ্তাহে আশি ঘন্টা কাজ করে কিম্ভুতকিমাকার হয়ে গেছে চেহারা কিন্তু অনেক ডলার বাংকে জমেছে। তাই চোখ উঠে গেছে আকাশে। বাংলাদেশী দেখলেই চোখ আকাশে উঠে যায়।
যাইহোক, ইতি টানি এখন। এদেশে অনেক কাজ করার সুযোগ আছে বলেই সবাই কাজ করে অনেক। বাংলাদেশে সেই সুযোগটা নেই, থাকলে হইতো ভিন্ন চিত্র দেখা যেত। আমি তো মনে করি এশিয়ার অন্য দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ অনেক অনেক ভালো করছে। শুধু যদি মন্ত্রীগুলো একটু ভালো হত, বাংলাদেশ আরো অনেক ভালো করত, বাংলাদেশকে আর বাংলাদেশীদের নিয়ে নাক শিটকানো কমত। দেশ ছাড়তে তখন আর আনন্দিত লাগত না। যারা এ দেশে কষ্ট করে জীবন যাপন করছেন, দেশের মানুষকে জানতে দিন, বিদেশ থাকাটা খুব বেশি উপভোগ্য না পরিবার ছেড়ে, এখানে খেঁটে খুটে উপার্জন করতে হয় , সেই উপার্জনের সাথে এক্সপেকটেশনের যেন সামঞ্জস্য থাকে, আপনার জীবনের সাথে অন্য যার জীবন সামাঞ্জস্য হয় তাকেই বিয়ে করা উচিত, আকাশ পাতাল তফাতে না যাওয়াই ভালো। সর্বপরি বাংলাদেশীদের দেখে নাক শিটকানো অবশ্যই বন্ধ করা উচিত। মনে রাখা উচিৎ, দেশকে ছোট করলে, নিজেই অনেক ছোট হবেন।
আমার লেখা কাউকে ব্যক্তিগত ভাবে আঘাত করে থাকলে, ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন। সুন্দর কিছু না হয়, এই ক্ষমা দিয়ে শুরু হোক। পহেলা ফাল্গুনের অনেক শুভেচ্ছা রইল।
লংমণ্ট, কলোরাডো
ফেব্রুয়ারী ১২, ২০১৪
No comments:
Post a Comment