মাতৃভাষা
ভাষার যে একটা আলাদা রূপ আছে, তা টের পেলাম গতকাল।
প্রত্যেকটি ভাষার একটা নিজস্ব সৌন্দর্য্য আছে । একটি ভাষার সেই সৌন্দর্য্য উপলব্ধি করতে গেলে বা বুঝতে গেলে, সেই ভাষাকে অনেক ভালো ভাবে আয়ত্ত করতে হবে । সবারই কোনো না কোনো ভাষা ভালো করে জানা আছে । অন্তত তার নিজের মাতৃভাষাটা ভালো করে জানার কথা । অনেকে বেশ কয়েকটি ভাষাও আয়ত্ত করতে পারে । তবে মাতৃ ভাষার স্বর, টান বা আবেগ যেভাবে প্রকাশ পায়, সেভাবে অন্য ভাষায় কথা বলা যায় না । তাই মাতৃ ভাষার সৌন্দর্যটা সব চেয়ে বেশি বোঝা যায় ।
এই সৌন্দর্যটা আরো বেশি বোঝা যায়, বাংলা ভাষাভাষী এলাকা থেকে ভিন্ন এলাকায় থাকাকালীন সময় ।
ছোটো বেলা থেকে বাংলা বলে আসছি, আসে পাশের সবাই বাংলা বলছে । মাতৃভাষাকে নিয়ে চিন্তা করার কথা মাথায় আসে নি । ফেব্রয়ারী আসলে, শহীদের শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে গান গেয়েছি, ফুল দিয়েছি। কিন্তু মাতৃভাষা বলার স্বাদ বা শোনার স্বাদ উপলব্দি করেতে পারিনি, ভাষা এত সুন্দর হতে পারে ভেবে দেখেনি । মাতৃভাষা ছেড়ে ভিন্ন ভাষাভাষী এলাকায় আসতেই উপলব্ধি করলাম, ভাষা কত মধুর হতে পারে, ভাষা কত সুন্দর হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন না :
"মা, তোর মুখের বাণী
আমার কানে লাগে
সুধার মতো"
বলতেও সুধার মতই লাগে, ভাবতেও অনেক ভালো লাগে।
আমি তেমন ভালো ইংলিশ বলতে পারি না । তবে আমি ভালো গ্রামার পারি, ইংরেজি গ্রামার । পরীক্ষায় পাশ করার জন্য গ্রামারের মত কঠিন জিনিস গিলে ফেলেছিলাম । কিন্তু কথা বলা ঠিক মত শেখা হয়নি। ইংরেজি গ্রামার এখনো শক্ত করে মনে গেঁথে আছে । কথা বলার আগে ইংরেজি গ্রামার মিলিয়ে, মনে মনে ট্রান্সলেসন করে তারপর ইংরেজি বলি । প্রায় এমন হয় যে, একটা ইংরেজি বাক্য বলে ফেলেছি, কিন্তু গ্রামারে ভুল হয়েছে, গ্রামার ঠিক আবার সেই বাক্য বলেছি । কিন্তু এখানে কেউ গ্রামার নিয়ে কেউ ভাবে না । কি বলতে চাইছি, সেটা বোঝাতে পারলেই হলো । তাই কেউ যদি, 'আমি যাচ্ছি' বলতে গিয়ে, 'আই অ্যাম গোইং' না বলে 'আই গো' বলে, তাহলেই হয়। 'আই অ্যাম কামিং' না বলে, 'আই আম কামিং' বলেই হয়। আমেরিকায় স্প্যানিশ দের আনাগোনা বেশি, ওরা এভাবেই কথা বলে। ওদের বিপুল জন সংখ্যার জন্য, স্প্যানিশ ভাষা এখানকার দ্বিতীয় ভাষা (সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ ).ওদের তাই ইংলিশ শেখার গরজ নেই । অনেক বাংলাদেশীও অভাবেই কথা বলে। আমি নিজেই এমন একজন । তবে আমি 'আই অ্যাম গোইং' কে 'আই গো' বলি না , এই যা ।
যা বলছিলাম, ইংরেজি কথা বলার আগে গ্রামার ঠিক করে, তারপর ঠিক করি ট্রান্সলেসন, তার পর বলা । অনেক সময় লেগে যায় । ভাব ভঙ্গি তো পরের কথা । কিন্তু আমার কলিগরা সবাই সাদা, ইংলিশ তাদের মাতৃ ভাষা । ফর ফর করে ওরা ইংলিশ বলে যায় । ভাব আবেগও থাকে । কিন্তু তাদের মত করে সতস্ফুর্ত ভাবে ইংরেজিতে বলতে পারি না । কেননা আমার ভাষা তো বাংলা, ওদের ভাষা তো ইংরেজি। ওদের দেশে এসেছি, ওরা তো বাংলা বলবে না, ইংরেজি বলেই আমাকে মনের কথা বলতে হবে। আমি গ্রামার আর ট্রান্সলেসন ঠিক করে ইংরেজি বলে যাচ্ছি, আর ওরা সতস্ফুর্ত ভাবে ইংলিশ বলছে, সুন্দর করে বলছে, আবেগ মিশিয়ে বলে যাচ্ছে, যারা শুনচ্ছে তাদেরও হয়ত ভালো লাগছে।
বাংলাভাষার সৌন্দর্যটা আমি টের পেলাম বিদেশে এসে, বিদেশীদের মাঝখানে বসে । বাংলায় কথা বলার সময় আমাকে ট্রান্সলেসন করে কিছু বলতে হয় না । কত দ্রুত, কত সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারি। এক শ্বাসে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারি। মনের আবেগ অনুভুতি মিশিয়ে কথা বলতে পারি । আমার কাছে মনে হল, এইটাই মাতৃভাষার সবচেয়ে সুন্দর দিক । বাংলা বলার সৌন্দর্যটা চোখে পড়ল এখানে এসে। বাংলা বলার জন্য বিদেশ বিভুইয়ে বাংলা বলার লোক খুঁজি। কাছে থেকে অনেক কিছুই সুন্দর লাগে না, দূরে গেলে তা চোখে পড়ে, মনে পড়ে। এতদিন পরে মাতৃভাষার সুন্দর দিকটা চোখে পরার, নিজের ভাষা বলতে পারার মত সুধা অনুভব করার পর, নিজের ভিতর একদিকে যেমন কুণ্ঠা বোধ করি, অনেক দেরি হয়েছে বলে; তেমনি অন্য দিকে আনন্দিত হই, দেরিতে হলেও মাতৃভাষার সুন্দর দিকটা ধরতে পারার কারনে, নিজের ভাষা বলতে পারার কারনে । মাতৃভাষা বাংলার এই সৌন্দর্য, এই অনুভুতির জন্যই হয়ত রফিক, শফিক, বরকতের মত অনেক তাজা তরুণ বাংলার ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে, শহীদ হয়েছে । এখন প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারী বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় । মাতৃভাষা রক্ষার জন্য, মাতৃভাষার বলার অধিকারের জন্য তাদের এই ত্যাগ, শ্রদ্ধা ভরে স্মরন করি। মাতৃভাষা বলা, শোনা আর অনুভুব করার মত অন্য কোনো ভাষাই হয় না। বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশের জন্য রইলো অনেক অনেক ভালবাসা।
No comments:
Post a Comment