Followers

Tuesday, February 11, 2014

কুয়াশা

কুয়াশাছন্ন সকাল। ঘন কুয়াশা। এখানেও কুয়াশা আসে। বেশি দূরে দেখা যায় না। আসতে আসতে গাড়ি চলছে।

কুয়াশা দেখলেই আমার খেঁজুর রসের কথা মনে হয়। মামার বাড়িতে শীতের সকালের খেঁজুরের রস। কি একটা আয়োজন ছিল।দল বেঁধে খালাতো মামাতো ভাইবোন যেতাম মামা বাড়িতে। মামা বলে রাখতেন কোন এক গাছিকে। হাটে যাবার আগে রস দিয়ে
যেত। দল বেঁধে খেঁজুরের রস খাওয়া। 

ভারী জামা কাপড় গাঁয়ে দিয়ে লাইনে দাড়িয়ে থাকা। যথেষ্ট রস থাকতো গাছির কাছে। যে যত খেতে পারে। এত্ত বড় ছিল গ্লাস। আমার টার্গেট দুই গ্লাস। পারলে আরো বেশি। এত মিষ্টি। ঠাঁণ্ডা রস খেতে খেতে গাঁয়ের লোম দাড়িয়ে যেতে। গলাও ধরে আসত ঠাঁণ্ডায়। প্রথম প্রথম এক টানে খেতাম অনেক খানি। তারপর যখন গলা ধরে আসত তখন, আসতে আসতে। মামা বলতেন,'একটানে খা।', 'কি বলিস মাত্র দুই গ্লাস, আরো নে!' আর এক গ্লাসও হয়ে যায়। কুয়াশা মানে খেঁজুরের রস খাওয়া, গ্লাসকে গ্লাস। এখানে খেজুরের গাছ নেই, গাছিও নেই। কুয়াশায় গাড়ি চলছে ধীরে ধীরে।

রসের পর্ব শেষে পিঠা পর্ব। রাতের বেলায় চিতৈ পিঠা দুধের রসে ভিজানো ছিল। দুধ পিঠা চিতৈ পিঠা। গুলো ভিজে তুলতুলে হয়ে থাকতো।কিছুকিছু পিঠার মাঝের অংশ ভিজত না। সেগুলো পোঁচা পিঠা। কারন সেগুলো ভিঝে নি। তবে মাঝের টুকু ছাড়া বাকি অংশ টুকু
খাওয়া যেতে। বেছে বেছে আমি ছোট গুলি নিতাম। কেননা ছোট গুলি বেশি তুলতুলে হত। পাটিশাপটা পিঠাও রাতে বানিয়ে রাখতেন মামী। সাথে সেমাই পিঠা। সকালে হত ভাপা পিঠা। দুই স্তরের এত্ত বড়। একটা খাওয়া ছিল বিরাট ব্যাপার। ঝাল আইটেমের মধ্যে ছিল গরুর মাংস দিয়ে গরম গরম চিতৈ পিঠা। এত টুকুন পেটে এত্ত কিছু কি করে খেতাম কে জানে। কুয়াশা মানে মামার বাড়িতেঅনেক অনেক পিঠা খাওয়া। এখানে মামা বাড়ি নেই, মাটির উনুন নেই, পিঠাও নেই। তবে জায়াগাটা গ্রাম গ্রাম লাগছে। রাস্তের দুই ধারে গুটি কয়েকটা বাড়ি। যেন ছোট্ট গ্রামের গুচ্ছ বাড়ি। যেন গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি।

সকালের খাওয়া শেষে খেলা শুরু। দারিয়া বান্ধা, মাংস চোর। দারিয়া বান্ধার কোর্ট ছিল পুকুরের পাশে। মাংস চোরের কোর্ট ছিল বাড়ির পিছনে। ও হ্যাঁ, কানা মাছি খেলাও হত আর হত লুকোচুরি খেলা। এক এক খেলায় এক ধরনের মজা। এক এক খেলায় এক এক ধরনের শাররিক ভাষা থাকতো। লুকোচুরি খেলার সময় নিজস্ব কিছু জায়গা থাকতো লুকানোর। দৌড়িয়ে গিয়ে লুকিয়ে থেকে চুপচাপ পদধ্বনি শোনা, কেউ কি এদিকে আসছে কিনা। হৃদপিণ্ডের শব্দ শোনা যেত খুব। কেউ কেউ হয়রান আর খেলবে না বলে উত্তেজিত দর্শক বনে যেত। সব খেলায় হৈচৈ হত দারুন। সব শেষে ঝগড়া দিয়ে খেলা শেষ হত। সেই রেশ শেষ হত পুকুরে গোসল করে। ঝুপ ঝাপ গোসল শেষ। বেজায় ঠাণ্ডা। কুয়াশায় ভেসে আসে দারিয়া বান্দা খেলা, মাংস চোর, কানা মাছি আর লুকোচুরি খেলা।

শীতের সকাল পেরলেই যেন ঝুপ করে বিকেল চলে আসে। বিকেল মানেই সরিষা ক্ষেত ভ্রমন। জমির পর জমি হলুদ আর হলুদ। যেন হলুদহলুদ কোন শাড়ি কেউ বিছিয়ে রেখেছে। শীতের বুড়ি হবে হয়তো। সরিষার মিষ্টি একটা ঘ্রান আছে। হাল্কা মিষ্টি ঘ্রান। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত
হয়ে গেলে আইলের উপরে বসে পড়া। তারপর অনেক অনেক গল্প। অনেক খুনসুটি। কখনো হাঁসতে হাঁসতে একজনের গায়ে আরেক জন পরেযাওয়া। কখনো মৌ মাছির মধু আহরন দেখা। কখনো গুন গুন করতে গান গাওয়া, কখনো জোরে জোরে। এরি মধ্যে সরিষা ফুল কারো
চুলে শোভিত হয়ে গিয়েছে সেই নিয়ে কত হাসা হাসি। কুয়াশা মানে হলুদের ক্ষেতে বসে আড্ডা দেওয়া। এখানে সরিষা ক্ষেত দেখিনি কখনো।সৃতিতে হলুদের সমারোহ। চারপাশে যদিও বরফ আর বরফ। সাদা বরফে ঠিকরে আসছে কিছু আলো। চোখ লাগে কেমন যেন। একে ইংলিশে
বলে হোয়াইট আউট। কুয়াশায় বের হয়ে ছিলাম। বেশি দূরে না, কাছে কোথাও। কুয়াশায় ভর করে কত স্মৃতি উঁকি দিয়ে গেল। কুয়াশার আর একটা মানে কিন্তু কবিতাকে মনে করা। কুয়াশাকে জীবনানন্দের মত সুন্দর করে আর কে সাজিয়েছে! তার একটি কবিতা দিয়ে শেষ করছি...

একদিন কুয়াশার


একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;
হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেই দিন- গিয়েছে যে শান্ত- হিম ঘরে,
অথবা সান্তনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল- পৃথিবীর এই মাঠখানি
ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন, এ মাঠের কয়েকটি শালিকের তরে
আশ্চর্য আর বিস্ময়ে আমি চেয়ে রব কিছু কাল অন্ধকার বিছানার কোলে,
আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে আজো কি মাঠের কুয়াশায়
ভেসে আসে? সেই ন্যাড়া অশ্বথে’র পানে আজো চলে যায়

সন্ধ্যা সোনার মত হলে
ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?
সন্ধ্যা হলে? মউমাছি চাক আজো বাঁধে না কি জামের নিবিড় ঘন ডালে,
মউ খাওয়া হয়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় কুয়াশায় সন্ধ্যার বাতাসে-
কতো দূরে যায়, আহা... অথবা হয়ত কেউ চালতার ঝরাপাতা জ্বালে
মধুর চাকের নিচে- মাছিগুলো উড়ে যায়... ঝরে পড়ে... মরে থাকে ঘাসে-

No comments:

Post a Comment