Followers

Tuesday, February 11, 2014

শিশিরবিন্দু

বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজকের ঘটনাটা ঘটেছে অনেকটা তাই। অনেক দিন ধরে, অনেক ব্যায় করে অনেক জায়গায় ঘুরে এসেছি, কিন্তু ঘর থেকে কিছু দূরে এত সুন্দর
জায়গায় থাকতে পারে কল্পনা করেনি।

সাধারণত কোন এক সপ্তাহে দূরে কোথাও গেলে, এর পরের সপ্তাহে অথবা দুই সপ্তাহে কোথাও যাওয়া হয় না। এই সময়ে ঘুম আর ঘুম, বিছানায় এলিয়ে নাটক মুভি দেখা। এরপর আবার দূরে কোথাও। গতবার গ্রীষ্মে অবশ্য প্রায় প্রতি সপ্তাহে কোথাও না কোথাও যাওয়া হয়েছে। এখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, বের হবার জো নেই।

গত সপ্তাহে দূরে কোথাও যাবার কারণে এই সপ্তাহে কোথাও যাবার প্ল্যান ছিল না। কিছুটা ব্রেক তার উপর এই রবিবারে সুমির ড্রাইভিং ক্লাস থাকায় কোথাও যাওয়া হয়নি। সকালে উঠে ড্রাইভিং স্কুলে গেলাম। দুই ঘণ্টার রোড প্র্যাকটিস। গত দুই লেসন আমিও সাথে ছিলাম। বসে বসে বোর হবার থেকে গাড়িতে ঘোরা ঢের ভাল।

বাসা থেকে স্কুল পর্যন্ত সুমিই আমাদের গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল। ধীরে ধীরে অনেক খানি শিখে গেছে। গাড়ি চালানোর প্রথম কয়েক দিন কি যে গেছে, অনেক ঝগড়াও হয়েছে। আমি নাকি বকা দেই বেশি। গাড়ি এলোমেলো চালালেও বকা দেওয়া যাবে না। ভুল করলে কিছু বলা যাবে না, এই সব। যাইহোক কঠিন দিন গেছে। এখন ভালই চালায়। ব্রাশ আপের জন্য স্কুলে ভর্তি করানো আর স্কুলে রোড টেস্টও দিতে পারবে। আজি শেষ লেসন।

গাড়িতে উঠলাম সবাই। আজ এক্সপ্রেস ওয়েতে গাড়ি চালাতে হবে। কিছু ক্ষণের মধ্যে গাড়ি এক্সপ্রেস ওয়ে তে উঠে যাবে। এর আগে ও কখনো এক্সপ্রেস ওয়েতে গাড়ি চালায়।এখানে এক্সপ্রেস ওয়েতে সবচেয়ে দ্রুত গাড়ি চলে। গতির ক্ষেত্রে সব চেয়ে কম লোকাল স্ট্রিট, তারপর অ্যাভেন্যু, তারপর বুল্যূভারড, হাইওয়ে সবশেষে এক্সপ্রেস ওয়ে। এক্সপ্রেস ওয়েতে অনেক সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়, একটু ভুলের কারনে অনেক বড় দূর ঘটনা ঘতে যেতে পারে। যেতে পারে মানুষের প্রানও। তাই এক্সপ্রেস ওয়েতে অনেক কিছু অনেক সতর্কতার সাথে চালাতে হয়। সব চেয়ে কঠিন কাজটা হচ্ছে এক্সপ্রেস ওয়েতে উঠা। সুমি এই কাজটা প্রথম করতে যাচ্ছে। সভাবতই অনেক উত্তেজিত।

আমি পিছনে বসে আছি, ভাল যে, ইন্ত্রুক্তরের কাছে আলাদা ব্রেক আছে, সুমি লাইট পাড় হয়ে ঢুকছে এক্সপ্রেস ওয়েতে। ওকে স্পীড বাড়াতে হবে ধীরে ধীরে এবং আসে পাশে গাড়ি দেখে এক্সপ্রেস ওয়ের লেনে ঢুকে পরতে হবে। ও গাড়ির স্পীড বাড়াচ্ছে, অনেক গাড়ি দ্রুত ছুটে যাচ্ছে, যে লেনের উপর ও আছে, সেটা শেষ হয়ে আসছে, ওকে এখনি লেন চাঞ্জ করতে হবে, লেন চাঞ্জও করলো, কিন্তু ও আর এক লেন চাঞ্জ করতে যাচ্ছিলো, আমি উত্তজিত হয়ে বলে ' No, Stay on this lane '! আমার চিৎকারের কারনেই হোক অথবা অন্য কারনে, ভাগ্যিস শেষ পর্যন্ত ও লেন চাঞ্জ করেনি। বড় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচা গেল।

গাড়ি দ্রুত চলছে। প্রাথমিক উত্তেজনা থেকে বের হয়ে এখন ভালই গাড়ি চালাচ্ছে। ইন্সট্রাকটর বলল , 'You did good job' বলে হাঁসে, আমি মনে মনে বলি বড় বাঁচা বেঁচে গেছি আজ।

এখন আমরা যাচ্ছি পাহাড়ি রাস্তায়। পাহাড়ি রাস্তায়ও আগে কখনোও গাড়ি চালায় নি। আজ যেহেতু শেষ লেসন, তাই যে বিষয়গুলো করা হয় নি, সেগুলোই করা হবে আজ। আমরা জানতাম, এক্সপ্রেস ওয়েতে গাড়ি চালাতে হবে, কিন্তু পাহাড়ি রাস্তায় চালাতে হবে এখন জানলাম, সুমির আজ
জীবনের বড় এবং মজার কিছু অভিজ্ঞতা হয়ে যাচ্ছে। দেখা যাক কেমন করে।

এখানকার পাহাড় গুলো অনেক খাড়া আর ঢালু। কিভাবে এখানে রাস্তা করেছে কে জানে। ইন্সট্রাকটর বলল, এই পাহাড়ি রাস্তা অন্যান্য পাহাড়ি রাস্তা থেকে কঠিন, কিন্তু নতুন গাড়ি চালকদের জন্য ভাল শিক্ষণীয়। রাস্তার লেন গুলো ও সুরু। আমি টাইট হয়ে, গাড়ির ফ্লোরে পা চাপ দিয়ে বসে থাকি। গাড়ি ধীরে ধীরে উঠছে। ভালই চালাচ্ছে, তবে অনেক আস্তে আস্তে, তাই পিছনে গাড়ির লাইন লেগে গেছে। অন্যদের যাবার জন্য জায়গা করে দেবার জন্য আমরা পথের পাশে জায়গা খুঁজছি। ওগুলিকে 'পুল ওভার' বলে। সামনে আবার পরল বাই সাইকেলিস্টের দল। ধীরে ধীরে চলছে গাড়ি আর আমরা থামানোর জায়গা খুঁজছি। অন্য দিক থেকে গাড়ি না আসায় আমরা বাই সাইকেলিস্টেদের ওভার টেক করে চলে গেলাম। ভালই ওভার টেক করলো, এবং কিছু দূর যেতেই থামানোর জায়গা পেয়ে গেলাম। গাড়ি থামতেই অন্য গাড়ি গুলো সাই সাই করে চলে গেল। পিছনে আর কেউ নেই, আমরা আবার উপরে উঠতে শুরু করলাম।

গাড়ি যতই উপরে উঠছে ততই যেন মোড় বাড়ছে, পাহাড়ি রাস্তায় প্রথম ভালই চালাচ্ছে ও। তবে খুব আস্তে আস্তে। অনেক দূর উঠে গিয়েছে আমরা, রাস্তার পাশ থেকে খাড়া নিছে দেখা যায়। ভয়ঙ্কর অবস্থা। পিছনে আবারো গাড়ি জমে গিয়েছে। বেশি জোরে চালাতে পারছে না বলে এমন হচ্ছে। অন্যদের জায়গা দেবার জন্য ইন্সট্রাকটর বলল। কিন্তু সামনে কোথাও পুল ওভার দেখা যাচ্ছে না। কিছু দূর চালানোর পড়ে সামনে একটা দেখা গেল, সুমি ওখানে থামানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যেই টার্ন করে থামাতে গিয়েছে, কিন্তু গাড়ি তত টুকু থামেনি। আমরা তো পুরা থ। ভাগ্যক্রমে ইন্সত্রুচতর পুরো ব্রেক করলো। আমরা ঠিক পড়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে থেমে গেলাম। অসম্ভব অবস্থা!

ওদের হৃদ স্পন্দনের কথা জানি না, তবে আমার হৃদ স্পন্দ অনেক বেড়ে গেল। একটু ব্রেক টাইম। সুমির ললাটে কিছুটা ঘাম। ও পানি খাচ্ছে।

এমন হয় না, যে অনেক ধকলের পড়ে অদ্ভুত কিছু মুহূর্ত আসে? হ্যাঁ, আমাদের উপর দিয়ে ভালই ধকল গেল। গাড়ি থামিয়ে, আমরা পাহাড়ের ধার ঘেঁসে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর কি যে অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম! আহা! আসাধারন! সুন্দর দৃশ্য গুলো লেখায় ফুটিয়ে তোলা অনেকটা অসম্ভব। যেমন ধরুন জ্যোৎস্নার সৌন্দর্য, সমুদ্রের ভাল লাগা, আকাশে মেঘের ছোট ছোট ভেলার, সূর্যাস্ত আর সূর্য উদয়ের আসাধারন দৃশ্য লেখায় প্রকাশ করা দুরুহ, কিন্তু লেখায় আবেগের ছটা দিয়ে কিছুটা বোঝান যায়। পাহাড়ের এই দিকে এসে হতবাক হয়ে দাড়িয়ে আছি, আর যত দূর চোখ যায় তত দূর দেখছি। পুরো কলোরাডোর উত্তর দক্ষিন আর পূর্ব দিকটা এখান থেকে দেখা যায়। জলমলে দিনে দেখা যায় আরও দূরে। নিচের কিছু ছোট ছোট ঘর দেখা যায়, দূরে দুইটা ল্যাক দেখা যায়, এক্সপ্রেস ওয়েগুলোকে
সমান্তরাল রেখার মত দেখায়, গাড়ি গুলোকে পিঁপড়ের মত। পাহাড়ে আসলেই আমি বুক ভরে শ্বাস নেই, আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ে। হতে অক্সিজেনের অভাবে অথবা এত সুন্দরের কাছে নিজেকে তুচ্ছ মনে হবার কারণে। এদিকে আগে আসি নি বলে অবাক লাগছে অথচ কত দূর দুরান্তেই না গিয়েছি। কত সময় কত পথ পাড়ি দিয়েছি। আর আসাধারন কিছু খুব কাছেই পড়ে আছে।


লংমন্ট, কলোরাডো
January 26, 2014

No comments:

Post a Comment