Followers

Thursday, March 20, 2014

কলোরাডো

কলোরাডো


পৃথিবীটা অনেক বড়।

সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গেলে, অনেক বড়। ছোট্ট জীবনের তুলনায় অনেক অনেক বড়। কত টুকু আর দেখা যায়, এই জীবনে! চারপাশটা যদি ঘুরে ঘুরে দেখি, তাহলেও চলে যাবে জীবনের আধেকটা সময়। অনেক জায়গা তো আছে, বার বার যেতে ইচ্ছে করে, অনেকবার যাওয়া হয়। সব মিলিয়ে, জীবনের সময়ের সাথে পৃথিবীটাকে দেখার সময় খুবই কম। আশে পাশের জায়গাটুকুর মাঝে ঘুরে ফিরে কত কিছু দেখার আছে।

অনেকে তো আকাশ দেখেই জীবন পাড় করে দিল। আকাশ দেখার মাঝে কি যে নেশা আসে। মেঘহীন স্বচ্ছ নীল আকাশের মায়া বড় অদ্ভুত। একাধারে অনেক ক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে, মনে হয় আকাশটা অনেক কাছে চলে এসেছে। বায়বীয় নয়, তরল আকাশ। মনে হয় বিশাল সমুদ্র উল্টো হয়ে আছে, ঢেউহীন নীল সমুদ্র। হয়ত বা ঢেউ আছে, দূর থেকে দেখা যায় না, কে জানে।  যদিও এখনো আকাশ বলে কিছু আবিষ্কৃত হয়নি, এই নীল আকাশ শুধুই চোখের ফাঁকি। ক্লান্ত দৃষ্টি কিছু পায় না, বলে নীলে রঙ দেখে, মনে হয় ব্যদনার রঙ নীল, তাই মেঘমুক্ত স্বচ্ছ আকাশ নীল। আর এখানকার আকাশটা অনেক কাছে। হ্যাঁ, সমুদ্র সীমার ৪৮৫৪ ফুট উপরে লংমণ্ট, আকাশ তো কাছে লাগবেই।

পৃথিবীর কথা বলতে গিয়ে চলে গেলাম আকাশে। পৃথিবীতে ফিরে আসি। পাহাড়ের কথা বলি। আমি থাকি পাহাড়ের অনেক কাছাকাছি। আমার বারান্দায় দাঁড়ালেই পাহাড় দেখা যায়। বরফে ঢাকা পাহাড়। পাহাড়ের সারি। অনেক্ষন তাকিয়ে থাকা যায়। ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ আর দৃষ্টি বরফে ঢাকা পাহাড়ের দিকে, সময়ের কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি করে। আমি যখন গাড়ি চালিয়ে যায় পাহাড়ের পাশ দিয়ে, কত বার যে তাকায়, তার ইত্তায়া নেই। এই পাহাড়ের সারি থেকে চোখ ফেরন কঠিন কাজের একটি। একটা বিষয় লক্ষ করলাম কিছু দিন। পাহাড়ের উপরে জমে থাকা বরফ গুলো বাতাসে জোরে  উড়ে গেলে, অদ্ভুত এক ধরনের দৃশ্য তৈরি করে। মনে হয়, বরফ না, সাদা বালি উড়ে যাচ্ছে। কখন মনে হয়, ঠাণ্ডা ধোঁয়া উঠছে। মাঝে মাঝে মেঘগুলো পাহাড়ের খুব কাছা কাছি চলে যায়, নড়েচড়ে না, এক জায়গায় দাড়িয়ে থাকে, বাতাস আসলে দেই ছুট।  মনে হয় মেঘ গুলো পাহাড়ের বুক থেকে উঠে আসছে, পাহাড়ের আশে পাশে ঘুর পাক খাচ্ছে, ধমকা হাওয়া মেঘগুলোকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।  অদ্ভুত!

গরমের সময় বরফ থাকে না । তবে অন্য রকম এক ঘটনা ঘটে। দুপুরের রোদ্রে পাহাড় গুলো কে সুবিশাল লোহার স্তুপের মত লাগে। মনে হয় আদি কালে কেউ এখানে লোহার কারুকাজ করে রেখে গেছে। হয়ত সমুদ্রের ঢেউর আকৃতি করতে চেয়ে ছিল। এত বিশাল পাহাড়ের সারিকে ওরা ডাকে 'ফ্ল্যাট আইরন'। বিকেলের আলোয় একদম সমুদ্রের ঢেউর মত অসংখ্য ঢেউ এদিকে ছুটে আসে।

বেশ কিছু লেক আছে এখানে। ছোট বড়। চোখের মত এক লেক আছে কিছু দূরে। কাজল দিয়ে টানা চোখের মত।   শীতের সময় লেকগুলো বরফে ঢেকে যায় একদম। বরফ লেকের উপর খেলা হয় স্কেটিং। ছোট ছোট বাচ্চারা হেলে দুলে খেলে। কেউ কেউ বরফ ফুটো করে মাছ ধরে। হ্যাঁ, এরা মাছ ধরায় ওস্তাদ লোক আছে। বিশাল আয়োজন করে মাছ ধরে। মাছ ধরতে লাইসেন্স লাগে। তারপর ছিপি কেনা, নেট কেনা, বরফ খোদাই করার মেশিন, মাছ রাখার পাত্র কত কিছুর আয়োজন।  গ্রীষ্মের সময় তো কত কিছু করা যা, শীতের সময় ঘরে বসে থেকে কি হবে, মাছ ধরা বরঞ্চ অনেক ভাল।
কিছু কিছু লেক, ঠাণ্ডার সময়ও অনেক গরম পানিতে ভরে থাকে। এগুলোকে বলে হট স্প্রিং। কৃত্রিম উপায়ে না, প্রাকৃতিক ভাবেই এই  লেকগুলো গরম পানিতে ভরা থাকা। গরম বলতে গোসল করার মত উষ্ণ পানি। যেখানে অন্য সব লেকগুলো জমে বরফ, সেখানে এই হট স্প্রিংগুলো সহনীয় পানিতে টইটুম্বুর। দল বেঁধে লোকজন সাতার কাটতে যায়। কিছু হট স্প্রিং পাহাড়ে ঘেরা, অদ্ভুত পরিবেশ।

কিছু লেক রিজারভইর মানে পানি সংরক্ষণের জন্য বানানো হয়েছে। পুরো কলোরাডো জুড়ে অসংখ্য রিজারভইর। ভুলে গেলে চলবে না, কলোরাডো এক ধরনের মরুভুমি। লাল মাটি আর বিশাল বিশাল পাহাড়ের মরুভুমি। গ্রীষ্মের সময় প্রচণ্ড উত্তাপে যেন খরা না হয়, তার জন্য এই ব্যবস্থা। মাঝে মাঝে খরা দেখা দেই এদিকটায়। পানির অভাবে পাহাড়ে পাহাড়ে আগুন লাগে। ভয়ঙ্কর অবস্থা। খরার সময় অপ্রয়োজনে পানি খরচ করলে, জরিমানা গুনতে হয়।

এখানকার সবচেয়ে বড় নদী কলোরাডো রিভার। অনেক অনেক বড়। কোথাও কোথাও শুরু হয়েছে কোথাও অনেক প্রশস্ত। কিন্তু দীর্ঘ অনেক। এছাড়াও কিছু ছোট বড় নদী আছে, যেগুলোর অনেক গুলো শীতকালে শুকিয়ে যায়, গ্রীষ্মে কিছুটা পানি আসে। কলোরাডো রিভারে স্রোত থাকায় ঠাণ্ডায় জমে না। গ্রীষ্মের সময় নৌকায় চরে এক ধরনের খেলা হয়, এগুলোকে রেফটিং বলে। আঁকা বাকা নদীর বুকে ছোট ছোট নৌকার মত কায়াক চড়ায়।

শীতের শুরুতে অসংখ্য রাজহাঁস উড়ে যায় দক্ষিণে, গরমের খোঁজে। এগুলোকে ক্যানাডিয়ান গুজ বলে। কানাডা থেকে উড়ে উড়ে, আমেরিকা পাড়ি দিয়ে আরো দক্ষিণে যায়। দল বেঁধে,  এত্ত বড় বড় রাজহাঁস। উড়ার সময় অনেক শব্দ করে করে যায়। আমাদের দেশের অতিথি পাখির মত কিছু পাখি, এখানকার মাঠ ঘাটে, লেকে যাত্রা বিরতি নেই। কখনো  মাঠ জুড়ে রাজহাঁসে ভরে যায়। বরফ পরার সময় কিছু রাজহাঁসকে চুপচাপ মাঠের উপর বসে থাকতে দেখেছি। এরা দেরি করে যাত্রা শুরু করেছে বিধায় পিছনে পরে গেছে! এদের কেউ মারে না, ধরে না, এরা কাউকে ভয়ও করে না। নিশ্চিন্তে লেকে জমা হচ্ছে, মাঠে দল বেঁধে বসে আছে। রাজহাঁসের উড়ে এসে পানিতে নামাতা খুবই সুন্দর আবার উড়ে যাওয়াটা অদ্ভুত। ডানার জাপটায় একে একে সব উড়ে যায়। গ্রীষ্মের শুরুতে আবার দল বেঁধে উত্তরে যাওয়া। অনেক কোলাহল করে উড়তে উড়তে নিজের দেশে ফিরে যাওয়া।  

No comments:

Post a Comment